কার্ল মার্ক্সের ‘পুঁজি’-র সহজ পাঠ: পর্ব ১

Standard
কার্ল মার্ক্সের ‘পুঁজি’-র সহজ পাঠ: পর্ব ১

জার্মানে যার নাম ‘দাস কাপিতাল’, ইংরেজি অনুবাদে তা-ই ‘ক্যাপিটাল: আ ক্রিটিক অফ পোলিটিক্যাল ইকোনমি’। ক্যাপিটাল-এর সঙ্গে যে লেজুড়টি, তা জার্মান ভাষাতেও আছে। তবে সে-কথা বাংলায় লেখা এতই দুষ্কর যে সেদিক মাড়ালেম না।

এই ‘ক্যাপিটাল’ (বাংলায় ‘পুঁজি’) বইটি রচনা করেন কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স, যিনি ছিলেন একাধারে জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, সাংবাদিক এবং আরও অনেক কিছু। তাঁর সম্বন্ধে আমরা মোটামুটি অবগত আছি বলে তাঁকে নিয়ে বিশদে লেখার সাহস দেখালাম না।

মার্ক্সের ‘পুঁজি’ বই নিয়ে কথাবার্তা নিচের লেখাতেই আছে বলে ভূমিকা লম্বা করার প্রয়োজন দেখি না। এখন কেবল ওই ‘নিচের লেখা’ নিয়ে একটামাত্র কথা। ‘দাস কাপিতাল ফর বিগিনার্স’ নামে মাইকেল ওয়েন-লিখিত একটি বই ক’দিন আগে হস্তগত হল। বইটাতে চোখ বুলিয়েই মনে হল এটা বাংলায় অনুবাদ করে ফেললে অনেকের সুবিধে।

আমারও। কারণ ‘পুঁজি’ তো আমিও পড়িনি!

অলমিতি…

(পুঃ – আরও একটা কথা। ক্যাপিটালকে পুঁজি আর প্রফিটকে মুনাফা লিখতে আমার কলম সরে না। কিন্তু পরিভাষা হিসাবে এগুলো এতটাই চালু যে বদলে দিতে সাহস হল না।

ব্যাস, এখানেই আমার মৌলিক রচনার ইতি।)

গোড়ার কথা

কার্ল মার্ক্সের দাস কাপিতাল – প্রথম ভাগের প্রথম প্রকাশ ১৮৬৭ সালে। এই বই এর আগের বিশ বছর ধরে পুঁজিবাদ নিয়ে মার্ক্সের মৌলিক চিন্তাভাবনার ফসল।  

দাস কাপিতাল মোটের ওপর পুঁজিবাদের সমালোচনামূলক একটা লেখা। পুঁজিবাদের এই ধরণ বা ওই ধরণ নয়, এই বই লেখার সময়ে মার্ক্সের উদ্দেশ্য ছিল সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদের সেইসব লক্ষণগুলোকে দাগিয়ে দেওয়া, যাদের নজর করলে দেশকালনির্বিশেষে যে কোনও ধরণের পুঁজিবাদকে আমরা দেখলেই চিনতে পারব। এরকম বিশাল একটা ক্যানভাস নিয়ে পুঁজিবাদের এমন একটা সার্বিক অথচ বিমূর্ত আলোচনার কারণেই সম্ভবত দাস কাপিতাল পড়ে ওঠা কিছুটা কষ্টসাধ্য।

পুঁজিবাদের এরকম একটা ক্ষুরধার সমালোচনার অর্থ যে সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে পাঠক, আপনি, এবং লেখক, আমি রয়েছি, বেড়ে উঠেছি, যে সমাজকে সমাজ বলে চিনতে-জানতে শিখেছি, তাকেই আক্রমণ করে বসা। আমাদের যে সমস্ত জানাকে আমরা সাধারণ ‘অভিজ্ঞতালব্ধ’ জ্ঞান বলে জেনে-বুঝে এসেছি, বা আমাদের চারপাশের প্রতিষ্ঠানগুলো এতদিন আমাদের শিখিয়ে এসেছে, দাস কাপিতাল পড়তে বসলে তার অনেকগুলোরই বিরোধিতা চোখে পড়ে। দাস কাপিতাল পড়তে গিয়ে ধৈর্য হারানোর এ-ও এক কারণ।

একটা সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে বিগত প্রায় চারশো বছর ধরে। দাস কাপিতাল প্রকাশ হবার পর থেকেই পুঁজিবাদের পুরোহিতেরা মার্ক্সের তত্ত্বকে খারিজ করার চেষ্টা করে এসেছেন। তবু, যে তরুণ আজও মনের মধ্যে দুনিয়াদারী চিনে নেবার দায় অনুভব করেন, এই বই, বা মার্ক্সের তত্ত্বাবলী, আজও তাঁকে ভাবনার খোরাক জোগায়। কিন্তু আজ প্রায় সারা বিশ্বেই তো পুঁজিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত এবং আমাদের জানা অন্যান্য যে কোনও সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার থেকে বলে প্রতিপত্তিতে যোজন যোজন এগিয়ে। তাহলে মার্ক্সসাহেবের এই বই আদৌ পড়ার দরকারটা কোথায়?

চারপাশে যা ঘটছে তার সবটাই যে ভালো হচ্ছে না – বেশির ভাগ লোকেরই অন্তত এই ধারণাটা আছে। আর যাঁরা মনে করেন মানবজাতি আজ বিশাল কিছু সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে (অর্থাৎ উপরের দলের ‘স্রেফ ধারণা’-র অতিরিক্ত যাঁরা আরও একটু খবরাখবর রাখেন), তাঁদের সংখ্যাটাও আজ বড়ো কম নয়। এই চারপাশে ঘটে-চলা বিবিধ অন্যায় আর মানুষের সামনে ঘনিয়ে আসা প্রবল বিপদ, এইসবের কার্যকারণের সবথেকে নিয়মনিষ্ঠ এবং গোছানো বিশ্লেষণ যদি কোথাও থেকে থাকে, তা আছে মার্ক্স-বিরচিত দাস কাপিতালেই। আর কোথাও নয়। দাস কাপিতালকে পড়ে ওঠার দরকারটা ঠিক এখানেই।

তবে, একটা বাক্সের গায়ে অর্থনীতির লেবেল লাগিয়ে তার মধ্যে দাস কাপিতালকে ভরে ডালা ফেলে দেওয়াটা একেবারেই সমীচীন হবে না। অর্থনীতি ছাড়াও এই বইতে একই সঙ্গে রাজনীতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন এবং থেকে-থেকে সাহিত্যেরও (মার্ক্সের লিখনশৈলী কিছু জায়গায় এতটাই সমৃদ্ধ আর ভাব-জাগানিয়া) মিশেল রয়েছে। রয়েছে মার্ক্সের সাহিত্য-আলোচনার শুরুর দিকের উদাহরণও। অর্থ, অর্থাৎ টাকাপয়সা-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়কে বোঝানোর জন্য বইয়ের জায়গায়-জায়গায় তিনি উদ্ধৃতি দিয়েছেন শেক্সপীয়ার, গ্যোতে এবং বালজাকের মত মহান কলমকারদের।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বুর্জোয়া সম্প্রদায় (আরও ছড়িয়ে বলতে গেলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা) কেমন করে ‘আরও টাকা কামাবো না পুঞ্জিত সম্পদ ভোগ করব’ – এই প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, তা বোঝাতে আর বুর্জোয়াজনের বিশ্বাসযোগ্য ছবি আঁকতে মার্ক্স উদ্ধৃত করছেন মহামতি গ্যোতে-বিরচিত করুণরসের নাটক ‘ফাউস্ত’-এর মুখ্যচরিত্রের বিলাপবাণী – “… কিন্তু বন্ধু দ্বৈতসত্তা পরস্পর দ্বন্দ্বরত আছে সর্বক্ষণ / এক সত্তা অপর্যাপ্ত স্থূল সুখ চায়। / পৃথিবীর যেইখানে ইন্দ্রিয় বিবশ করা বর্ণগন্ধ রাজে / অবুঝ শিশুর মতো সেই দিকে দু’হাত বাড়ায়… (আহমদ ছফাকৃত অনুবাদ)”

ক্রমে আমরা দেখতে পাব, একই দেহের দুটি সত্তার পরস্পরের থেকে দূরে চলে যাওয়াকে (পরস্পর-বিরোধী কর্তব্যের মধ্যিখানে দ্বিধাদীর্ণ মানুষ) মার্ক্স কেমন করে পুঁজিবাদের অন্যতম অভিজ্ঞান হিসাবে ব্যবহার করছেন।

অর্থাৎ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, দর্শন এবং সাহিত্য অধ্যয়ন করে, তাদের উদ্ধৃত করে, মার্ক্স চিনতে এবং চেনাতে চাইছেন এদের গভীরে লুকিয়ে থাকা সোশাল কন্টেন্ট বা সমাজের প্রাণভোমরাকে। আমাদের সুবিধার জন্য এর নাম আমরা রাখলাম ‘সামাজিক সারবস্তু’।

দাস কাপিতালে এহেন প্রাণভোমরার সুলুকসন্ধানের প্রধানতম উদ্দেশ্য হল কেন এবং কীভাবে অর্থ, মুনাফা, পুঁজি ইত্যাকার অর্থনৈতিক কারকেরা সামাজিক সারবস্তুকে দমন করতে চায়, যদিও এদের সকলেরই জনক সামাজিক সারবস্তু নিজেই। এই অর্থ, মুনাফা, পুঁজি ইত্যাদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে কী রকমভাবে প্রভাবিত করে রাখে তার সম্বন্ধে আমাদের কিছু ধারণা তো আছেই। দাস কাপিতাল তার সুপ্রশস্ত এবং সুবিন্যস্ত পরিসরে যে ভাবে এই বিষয়গুলোকে ধরে ধরে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের সামনে হাজির করে, গড়পড়তা অর্থনীতির চালু কথাবার্তার থেকে তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা এতটাই বেশি, যে এই আমাদের ধারণাগুলো ক্রমে আরও স্বচ্ছ হয়ে আসে।

দাস কাপিতালের শুরুটা খানিকটা গোয়েন্দা গল্পের মত। যে সব ছোট ছোট ঘটনা আমাদের সামনে ও চারদিকে ঘটছে (বা ‘ক্লু’ রেখে যাচ্ছে), সেগুলোকে জুড়ে জুড়ে একটা বড় ছবি – যার কথা আমরা হয়ত ভেবেও দেখিনি – দাস কাপিতাল তৈরি করে ফেলে। ইন্সপেক্টর মার্ক্স যখন সিনে এলেন, খুনটা হয়েছে কি হয়নি তখনও আমরা জানি না। কিন্তু খুনটা যে হয়েছেই, কালক্রমে সেইটা আমরা ধরে ফেলতে পারি।

Leave a comment