Monthly Archives: May 2022

কার্ল মার্ক্সের ‘পুঁজি’-র সহজ পাঠ: পর্ব ২

Standard
কার্ল মার্ক্সের ‘পুঁজি’-র সহজ পাঠ: পর্ব ২

পরিচ্ছেদ ১: পণ্য (কমোডিটি)

মার্ক্স পুঁজিবাদের সমালোচনার সূত্রপাত করলেন অতি সাধারণ, আটপৌরে একটা জিনিস দিয়ে। তার নাম জিনিস, বা কমোডিটি, বা পণ্য। দাস কাপিতালের শুরুটা হচ্ছে এইভাবে –

যে সমস্ত সমাজে উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলিত থাকে, সেখানকার ধনসম্ভার প্রতীয়মান হয় ‘পণ্যের এক বিপুল সম্ভাররূপে। এক একটি পণ্য তার এক একটি একক। কাজেই আমাদের তত্ত্বজিজ্ঞাসা শুরু করতে হবে যে-কোনো একটি পণ্যের বিশ্লেষণ থেকে (অনুবাদ – পীযূষ দাশগুপ্ত)।

  • মার্ক্স, দাস কাপিতাল

আমরা সকলেই বিলক্ষণ জানি যে পণ্য বা কমোডিটি এমন একটা জিনিস যার হয় কেনাবেচা হয়ে থাকে, অথবা সমগুরুত্বের (সমমূল্যের – না-ও হতে পারে) অন্য কোনও পণ্যের সঙ্গে বিনিময় হয়ে থাকে (যেখানে টাকাপয়সার গল্প নেই)।

আর এটাও জানি, যে কেনাবেচা (বা বিনিময়) যে আদৌ ঘটে তার কারণ পণ্য মানুষের কাছে একটা কাজের জিনিস।

তার মানে, একটা পণ্যের দুটো দিক রয়েছে। একটা যদি হয় তার ব্যবহারিক গুরুত্বের দিক, অন্যটা নিশ্চিতভাবে তার বিনিময়মূল্য। একটা পণ্যের বিনিময়মূল্য হল সোজা কথায় তার দাম।

তাহলে, পণ্যের শুরুওয়াতি সংজ্ঞা হল এইরকম: যে কাজের জিনিস কেনাবেচা হয় তা-ই হল পণ্য। এভাবে বললে পণ্যের দুটো দিকেই – ব্যবহারমূল্য (কাজের জিনিস) আর বিনিময়মূল্য (কেনাবেচা) – একসঙ্গে নজর দেওয়া যায়।

প্রথম দৃষ্টিতে পণ্যকে মনে হয় যেন একটি তুচ্ছ বস্তু এবং সহজেই বোধগম্য। কিন্তু বিশ্লেষণের ফলে দেখা গেলো যে তা বহু আধ্যাত্মিক (theological) ও আধিবিদ্যক (metaphysical) সূক্ষ্ম তত্ত্বে পরিবৃত একটি অদ্ভুত ব্যাপার (অনুবাদ – পীযূষ দাশগুপ্ত)।

  • মার্ক্স, দাস কাপিতাল

পণ্যকে সাদা চোখে একটা মামুলি সহজবোধ্য জিনিস বলে মনে হলেও মার্ক্স দেখাচ্ছেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে কোনও জিনিসকে যেমন দেখায়, আদতে সেই জিনিসটা তেমন না-ও হতে পারে।

আসলে, আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পণ্যের এই ব্যবহারমূল্য আর বিনিময়মূল্য মধ্যেও যে একটা লড়াই আছে, বিশ্লেষণের মাধ্যমে মার্ক্স সেটাই দেখাচ্ছেন।

প্রথমে ব্যবহারমূল্যের দিকটা দেখা যাক। যে কোনও কয়েকটা পণ্যের কথা ভেবে নেওয়া যাক – যেমন টিব্যাগ, হাতুড়ি আর বাইনোকুলার।

এদের ব্যবহারমূল্যের কথা ভাবতে গেলে আমরা দেখব এইসব জিনিসগুলোর ব্যবহার বা কার্যকারিতা একে অন্যের থেকে কতটা আলাদা। প্রতিটা জিনিসকেই একদম স্পষ্ট আর আলাদা কাজে ব্যবহার করা হয়।

টিব্যাগ দিয়ে পেরেক পোঁতা যেমন অসম্ভব, দূরের জিনিসকে হাতুড়ির সাহায্যে বড় করে দেখাও তেমনি অসম্ভব। নয় কি?

যেকোন জিনিসের ব্যবহার-মূল্যের উদ্ভব হয়েছে তার উপযোগিতা (utility) থেকে। কিন্তু এই উপযোগিতা আকাশ থেকে পড়ে না। পণ্যের পদার্থগত গুণাবলীর দ্বারা তা সীমাবদ্ধ, তাই পণ্য থেকে স্বতন্ত্র কোন সত্তা তার নেই (অনুবাদ – পীযূষ দাশগুপ্ত)।

  • মার্ক্স, দাস কাপিতাল

ওপরে যে জিনিসগুলোর কথা আমরা বললাম, তাদের গঠনের ওপরেই তাদের চেহারাগত আর ব্যবহারগত পার্থক্য নির্ভর করে।

যে টিব্যাগের গায়ে ছোট ছোট ফুটো নেই, তা দিয়ে চা বানানো যাবে কি? না।

যে বাইনোকুলারের ভেতরে লেন্স পোরা নেই, ব্যবহার করা যাবে না তাকেও।

সুতরাং, এইসব জিনিসগুলোর কার্যকারিতা নির্ভর করে যে যে জিনিস দিয়ে এগুলো তৈরি, তাদের ওপর, আর তাদের গঠনগত বৈশিষ্ট্যের ওপর।

এই যে জিনিস বা পণ্য, তা তৈরি হয় যে যে উপাদানে, তার যোগান কোথা থেকে আসে? সমস্ত উপাদানেরই জীবন অবশ্যম্ভাবীভাবে শুরু হয় কোনও একটা প্রাকৃতিক সম্পদের রূপ নিয়ে। চা আসে চা গাছ থেকে, টিব্যাগ তৈরি হয় কাঠ আর শাকসবজির আঁশ মিশ খাইয়ে। হাতুড়ির জন্য ইস্পাত তৈরি হয় লোহা আর কার্বনের যোগ ঘটিয়ে। লেন্সের জন্য যে কাচ, তার উৎস বালিকণা আর চুন।

এ কথা বলাই বাহুল্য যে প্রকৃতি নিজের থেকে তার নিজস্ব সম্পদের রূপ বদলে আমাদের আরও ভাল আর আরও আরামে রাখার জন্য এই হাতুড়ি, টিব্যাগ বা বিনোকুলার তৈরি করে দেয় না। এই রূপান্তরের আড়ালে থাকে মানুষের শ্রম (হিউম্যান লেবার), মাঝে মাঝে যা কি না ম্যাজিকের মত কাজ করে।

প্রথমতঃ, শ্রম হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে মানুষ এবং প্রকৃতি উভয়েই অংশ গ্রহণ করে, এবং যেখানে মানুষ স্বেচ্ছায় তার নিজের এবং প্রকৃতির মধ্যেকার বাস্তব প্রক্রিয়াগুলি সূচনা করে, নির্ধারণ করে, নিয়ন্ত্রণ করে। প্রকৃতির উৎপাদন-সমূহকে তার বিবিধ অভাবের সঙ্গে উপযোজিত আকারে আত্মীকৃত করার উদ্দেশ্যে সে নিজেকে প্রকৃতির বিপরীতে স্থাপন করে প্রকৃতিরই অন্যতম শক্তি হিসাবে। এইভাবে বাহ্য জগতের উপরে কাজ করে এবং তাকে পরিবর্তিত করে, সে সেই সঙ্গে তার নিজের প্রকৃতিরও পরিবর্তন ঘটায়। সে তার সুপ্ত শক্তিগুলিকে বিকশিত করে এবং সেগুলিকে বাধ্য করে তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে।

মার্ক্স, দাস কাপিতাল (অনুবাদ – পীযূষ দাশগুপ্ত)

সুতরাং, পণ্যের ব্যবহারিক মূল্যের আসল উৎস হল প্রকৃতি এবং শ্রম। আর এই কথাটা কেবলমাত্র পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সত্যি নয়, মানবজাতির সমগ্র ইতিহাসের ক্ষেত্রে সত্যি। মানুষ চিরকাল প্রাথমিকভাবে ব্যবহারমূল্যের কথা মাথায় রেখেই প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করেছে। আর উৎপাদনের পদ্ধতি এইরকম বলেই সে ক্রমশঃ সৃজনশীল আর বুদ্ধিমান হয়ে উঠতে পেরেছে।

মানুষের এই শ্রম ব্যবহারের পদ্ধতি অন্যান্য জীবজন্তুর সহজাত প্রবৃত্তি ব্যবহারের অভ্যাসের থেকে একেবারেই আলাদা।

একটা মাকড়সা এমন অনেক ক্রিয়া সম্পাদন করে, যেগুলি একজন তন্তুবায়ের দ্বারা সম্পাদিত বিবিধ ক্রিয়ার অনুরূপ, এবং মৌচাক নির্মাণের কাজে একটা মৌমাছি একজন স্থপতিকেও লজ্জা দেয়। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ স্থপতি এবং সবচেয়ে ভাল মৌমাছির মধ্যে পার্থক্য এই যে, স্থপতি তার ইমারতটি বাস্তবে গড়ে তোলার আগে গড়ে তোলে তার কল্পনায়। প্রত্যেকটি শ্রম-প্রক্রিয়ার শেষে আমরা পাই এমন একটি ফল, যেটি ওই প্রক্রিয়ার শুরুতেই ছিল শ্রমিকটির কল্পনা। যে-সামগ্রীটির উপরে সে কাজ করে, সে কেবল তার রূপেরই পরিবর্তন ঘটায় না, সে তার মধ্যে রূপায়িত করে তার নিজেরই একটি উদ্দেশ্য, যা তার কর্মপ্রণালীটিকে করে একটি নিয়মের অনুসারী, যে-নিয়মটির কাছে তার নিজের অভিপ্রায়ও বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য।

মার্ক্স, দাস কাপিতাল (অনুবাদ – পীযূষ দাশগুপ্ত)

মানুষ উদ্ভাবনকুশল হতে পারে, কারণ সে নিজের সৃজনশীলতা আর কল্পনাশক্তির দ্বারা প্রভাবিত, সহজাত প্রবৃত্তিদ্বারা নয়। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া আর পরিবেশকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা, দুই-ই তার পক্ষে সম্ভব। সে নিজের ভিতরের এবং বাইরের চারপাশের ঘটনাক্রমের কারণ আবিষ্কার করতে সক্ষম। এই কারণেই প্রাকৃতিক ইতিহাসের থেকে সম্পূর্ণরকমের আলাদা পথে মানুষের ইতিহাস তৈরি হওয়া সম্ভব।

মানুষের হাতজোড়ার যন্ত্র তৈরিতে সক্ষম অঙ্গ হিসাবে রূপ নেওয়াটা মানবেতিহাসের একটা মোড় ঘুরিয়ে দেবার মত ঘটনা। মার্ক্সের আজীবনের বন্ধু ও সহযোগী ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস লিখছেন:

…বানর থেকে মানুষে উত্তরণের হাজার হাজার বৎসর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে সব কাজকর্মে তাদের হাতকে ক্রমে ক্রমে অভ্যস্ত করে তুলেছিল, গোড়ার দিকে সেগুলির নেহাতই সাদাসিধে ধরনের হওয়ার কথা। নিম্নতন স্তরের বন্য মানুষেরা, এমন কি যাদের দেহগতভাবে অবনতি এবং সঙ্গে সঙ্গে পশুসুলভ অবস্থায় অধোগতি ঘটেছে বলে অনুমান করা হয়, তারাও এই উত্তরকালীন প্রাণীদের তুলনায় ঢের বেশি উন্নত। মানুষের হাতে পাথর থেকে প্রথম ছুরিখানা তৈরি হবার আগে হয়ত এমন এক দীর্ঘ যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, যার তুলনায় আমাদের পরিচিত এই ঐতিহাসিক যুগকে মনে হবে একান্তই নগণ্য। কিন্তু তারই মধ্যে চূড়ান্ত পদক্ষেপটা নেওয়া হয়ে গিয়েছিল: হাত হল মুক্ত, তখন থেকে তা অর্জন করে যেতে পারল ক্রমেই বেশি বেশি নৈপুণ্য ও কৌশল; এবং এইভাবে অর্জিত উন্নততর নমনীয়তা সঞ্চারিত হল বংশপরম্পরায়, বৃদ্ধি পেল পুরুষানুক্রমে।

  • বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা, ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস

তার মানে, মানুষ হিসাবে আমরা যেটুকু যা হয়েছি, তার পিছনের আসল কারণটি হল শ্রম। শ্রমের ব্যবহারমূল্য আবার এক-এক রকমের উপাদানের ওপর কাজ করে তাদের এক-এক রকমের গুণপনা বের করে আনে।

আমরা যদি কাগজ তৈরি করতে যাই, তবে কাঠকে লোহার আকরিক মনে করে চুল্লিতে দিলে যা হবার তাই হবে! প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর নিজের নিজের বৈশিষ্ট্য বা গুণগুলোকে বুঝে নিয়েই শ্রমকে কাজ করতে হবে।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমের কোন গতি হয়, সে কথা জানতে এইখানে আমাদের মনে করতে হবে শ্রম ও সৃজনশীলতার অঙ্গাঙ্গীভাবে মিলে থাকা নিয়ে মার্ক্সের রচনার কথা।  

মানবিক শ্রম দুই ধরনের জিনিস তৈরি করতে পারে। প্রথম ধরনটা হচ্ছে ছোট-ছোট যন্ত্রাংশ বা এমন কিছু উপাদান যার ওপরে আরও শ্রম লাগিয়ে অন্যতর জিনিসপত্র তৈরি করা হবে। অন্য ধরনটা হল সেইসব জিনিস যা চূড়ান্ত অবস্থায় ব্যক্তিমানুষের হাতে আসবে, এবং ব্যক্তিমানুষ তাকে ব্যবহার করবে বেঁচে থাকার জন্য – যেমন একটা ঘরের চাল বা কিছু খাবারদাবার।

প্রথম ধরনের জিনিসগুলোর এমন কিছু প্রচ্ছন্ন বা লুকোনো ব্যবহারমূল্য থাকে যেগুলো আরও শ্রম প্রয়োগ করলে তবেই প্রকাশ্যে আসতে পারে।

জীবন্ত শ্রম এদেরকে আয়ত্তে আনবে, মরণ-ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে, নিছক সম্ভাব্য ব্যবহার মূল্য থেকে এদের পরিবর্তিত করবে বাস্তব ও কার্যকর ব্যবহার-মূল্যে। শ্রমের অনলে অভিষিক্ত হয়ে, শ্রমের দেহযন্ত্রের অঙ্গীভূত হয়ে এবং যেন সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে নিজেদের কর্তব্য-কর্ম সম্পাদনের জন্য সঞ্জীবিত হয়ে, এরা বাস্তবিক পক্ষে পরিভুক্ত হয়, কিন্তু পরিভুক্ত হয় একটি উদ্দেশ্য অনুযায়ী – নোতুন নোতুন ব্যবহার-মূল্যের নোতুন নোতুন উৎপন্ন দ্রব্যের বিবিধ প্রাথমিক উপাধান হিসাবে, যে-মূল্যগুলি তথা দ্রব্যগুলি প্রাণ-ধারণের উপায় হিসাবে ব্যক্তিগত পরিভোগের জন্য, উৎপাদনের উপায় হিসাবে কোন নোতুন শ্রম, প্রক্রিয়ার জন্য সদা-প্রস্তুত।

মার্ক্স, দাস কাপিতাল (অনুবাদ – পীযূষ দাশগুপ্ত)

মার্ক্স বলছেন, ছোট-ছোট যন্ত্রাংশ (বা ক্ষেত্রবিশেষে মেশিনপত্তর) বা কাঁচামাল, নানান উপাদান বা উপকরণের মধ্যেকার প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনাগুলোকে আলোতে আনতে গেলে (বা তাদের লুকোনো ব্যবহারমূল্যগুলোকে প্রকাশ্যে আনতে গেলে) দরকার ‘জীবন্ত শ্রম’ বা ‘লিবিং লেবার’-এর। পরবর্তীতে পুঁজিবাদকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মার্ক্স, আমরা দেখব, তাঁর এই বক্তব্যের ওপরে খুব জোর দিচ্ছেন।

এখন প্রশ্ন হল, কী এই জীবন্ত শ্রম?

কার্ল মার্ক্সের ‘পুঁজি’-র সহজ পাঠ: পর্ব ১

Standard
কার্ল মার্ক্সের ‘পুঁজি’-র সহজ পাঠ: পর্ব ১

জার্মানে যার নাম ‘দাস কাপিতাল’, ইংরেজি অনুবাদে তা-ই ‘ক্যাপিটাল: আ ক্রিটিক অফ পোলিটিক্যাল ইকোনমি’। ক্যাপিটাল-এর সঙ্গে যে লেজুড়টি, তা জার্মান ভাষাতেও আছে। তবে সে-কথা বাংলায় লেখা এতই দুষ্কর যে সেদিক মাড়ালেম না।

এই ‘ক্যাপিটাল’ (বাংলায় ‘পুঁজি’) বইটি রচনা করেন কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স, যিনি ছিলেন একাধারে জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, সাংবাদিক এবং আরও অনেক কিছু। তাঁর সম্বন্ধে আমরা মোটামুটি অবগত আছি বলে তাঁকে নিয়ে বিশদে লেখার সাহস দেখালাম না।

মার্ক্সের ‘পুঁজি’ বই নিয়ে কথাবার্তা নিচের লেখাতেই আছে বলে ভূমিকা লম্বা করার প্রয়োজন দেখি না। এখন কেবল ওই ‘নিচের লেখা’ নিয়ে একটামাত্র কথা। ‘দাস কাপিতাল ফর বিগিনার্স’ নামে মাইকেল ওয়েন-লিখিত একটি বই ক’দিন আগে হস্তগত হল। বইটাতে চোখ বুলিয়েই মনে হল এটা বাংলায় অনুবাদ করে ফেললে অনেকের সুবিধে।

আমারও। কারণ ‘পুঁজি’ তো আমিও পড়িনি!

অলমিতি…

(পুঃ – আরও একটা কথা। ক্যাপিটালকে পুঁজি আর প্রফিটকে মুনাফা লিখতে আমার কলম সরে না। কিন্তু পরিভাষা হিসাবে এগুলো এতটাই চালু যে বদলে দিতে সাহস হল না।

ব্যাস, এখানেই আমার মৌলিক রচনার ইতি।)

গোড়ার কথা

কার্ল মার্ক্সের দাস কাপিতাল – প্রথম ভাগের প্রথম প্রকাশ ১৮৬৭ সালে। এই বই এর আগের বিশ বছর ধরে পুঁজিবাদ নিয়ে মার্ক্সের মৌলিক চিন্তাভাবনার ফসল।  

দাস কাপিতাল মোটের ওপর পুঁজিবাদের সমালোচনামূলক একটা লেখা। পুঁজিবাদের এই ধরণ বা ওই ধরণ নয়, এই বই লেখার সময়ে মার্ক্সের উদ্দেশ্য ছিল সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদের সেইসব লক্ষণগুলোকে দাগিয়ে দেওয়া, যাদের নজর করলে দেশকালনির্বিশেষে যে কোনও ধরণের পুঁজিবাদকে আমরা দেখলেই চিনতে পারব। এরকম বিশাল একটা ক্যানভাস নিয়ে পুঁজিবাদের এমন একটা সার্বিক অথচ বিমূর্ত আলোচনার কারণেই সম্ভবত দাস কাপিতাল পড়ে ওঠা কিছুটা কষ্টসাধ্য।

পুঁজিবাদের এরকম একটা ক্ষুরধার সমালোচনার অর্থ যে সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে পাঠক, আপনি, এবং লেখক, আমি রয়েছি, বেড়ে উঠেছি, যে সমাজকে সমাজ বলে চিনতে-জানতে শিখেছি, তাকেই আক্রমণ করে বসা। আমাদের যে সমস্ত জানাকে আমরা সাধারণ ‘অভিজ্ঞতালব্ধ’ জ্ঞান বলে জেনে-বুঝে এসেছি, বা আমাদের চারপাশের প্রতিষ্ঠানগুলো এতদিন আমাদের শিখিয়ে এসেছে, দাস কাপিতাল পড়তে বসলে তার অনেকগুলোরই বিরোধিতা চোখে পড়ে। দাস কাপিতাল পড়তে গিয়ে ধৈর্য হারানোর এ-ও এক কারণ।

একটা সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে বিগত প্রায় চারশো বছর ধরে। দাস কাপিতাল প্রকাশ হবার পর থেকেই পুঁজিবাদের পুরোহিতেরা মার্ক্সের তত্ত্বকে খারিজ করার চেষ্টা করে এসেছেন। তবু, যে তরুণ আজও মনের মধ্যে দুনিয়াদারী চিনে নেবার দায় অনুভব করেন, এই বই, বা মার্ক্সের তত্ত্বাবলী, আজও তাঁকে ভাবনার খোরাক জোগায়। কিন্তু আজ প্রায় সারা বিশ্বেই তো পুঁজিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত এবং আমাদের জানা অন্যান্য যে কোনও সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার থেকে বলে প্রতিপত্তিতে যোজন যোজন এগিয়ে। তাহলে মার্ক্সসাহেবের এই বই আদৌ পড়ার দরকারটা কোথায়?

চারপাশে যা ঘটছে তার সবটাই যে ভালো হচ্ছে না – বেশির ভাগ লোকেরই অন্তত এই ধারণাটা আছে। আর যাঁরা মনে করেন মানবজাতি আজ বিশাল কিছু সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে (অর্থাৎ উপরের দলের ‘স্রেফ ধারণা’-র অতিরিক্ত যাঁরা আরও একটু খবরাখবর রাখেন), তাঁদের সংখ্যাটাও আজ বড়ো কম নয়। এই চারপাশে ঘটে-চলা বিবিধ অন্যায় আর মানুষের সামনে ঘনিয়ে আসা প্রবল বিপদ, এইসবের কার্যকারণের সবথেকে নিয়মনিষ্ঠ এবং গোছানো বিশ্লেষণ যদি কোথাও থেকে থাকে, তা আছে মার্ক্স-বিরচিত দাস কাপিতালেই। আর কোথাও নয়। দাস কাপিতালকে পড়ে ওঠার দরকারটা ঠিক এখানেই।

তবে, একটা বাক্সের গায়ে অর্থনীতির লেবেল লাগিয়ে তার মধ্যে দাস কাপিতালকে ভরে ডালা ফেলে দেওয়াটা একেবারেই সমীচীন হবে না। অর্থনীতি ছাড়াও এই বইতে একই সঙ্গে রাজনীতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন এবং থেকে-থেকে সাহিত্যেরও (মার্ক্সের লিখনশৈলী কিছু জায়গায় এতটাই সমৃদ্ধ আর ভাব-জাগানিয়া) মিশেল রয়েছে। রয়েছে মার্ক্সের সাহিত্য-আলোচনার শুরুর দিকের উদাহরণও। অর্থ, অর্থাৎ টাকাপয়সা-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়কে বোঝানোর জন্য বইয়ের জায়গায়-জায়গায় তিনি উদ্ধৃতি দিয়েছেন শেক্সপীয়ার, গ্যোতে এবং বালজাকের মত মহান কলমকারদের।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বুর্জোয়া সম্প্রদায় (আরও ছড়িয়ে বলতে গেলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা) কেমন করে ‘আরও টাকা কামাবো না পুঞ্জিত সম্পদ ভোগ করব’ – এই প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, তা বোঝাতে আর বুর্জোয়াজনের বিশ্বাসযোগ্য ছবি আঁকতে মার্ক্স উদ্ধৃত করছেন মহামতি গ্যোতে-বিরচিত করুণরসের নাটক ‘ফাউস্ত’-এর মুখ্যচরিত্রের বিলাপবাণী – “… কিন্তু বন্ধু দ্বৈতসত্তা পরস্পর দ্বন্দ্বরত আছে সর্বক্ষণ / এক সত্তা অপর্যাপ্ত স্থূল সুখ চায়। / পৃথিবীর যেইখানে ইন্দ্রিয় বিবশ করা বর্ণগন্ধ রাজে / অবুঝ শিশুর মতো সেই দিকে দু’হাত বাড়ায়… (আহমদ ছফাকৃত অনুবাদ)”

ক্রমে আমরা দেখতে পাব, একই দেহের দুটি সত্তার পরস্পরের থেকে দূরে চলে যাওয়াকে (পরস্পর-বিরোধী কর্তব্যের মধ্যিখানে দ্বিধাদীর্ণ মানুষ) মার্ক্স কেমন করে পুঁজিবাদের অন্যতম অভিজ্ঞান হিসাবে ব্যবহার করছেন।

অর্থাৎ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, দর্শন এবং সাহিত্য অধ্যয়ন করে, তাদের উদ্ধৃত করে, মার্ক্স চিনতে এবং চেনাতে চাইছেন এদের গভীরে লুকিয়ে থাকা সোশাল কন্টেন্ট বা সমাজের প্রাণভোমরাকে। আমাদের সুবিধার জন্য এর নাম আমরা রাখলাম ‘সামাজিক সারবস্তু’।

দাস কাপিতালে এহেন প্রাণভোমরার সুলুকসন্ধানের প্রধানতম উদ্দেশ্য হল কেন এবং কীভাবে অর্থ, মুনাফা, পুঁজি ইত্যাকার অর্থনৈতিক কারকেরা সামাজিক সারবস্তুকে দমন করতে চায়, যদিও এদের সকলেরই জনক সামাজিক সারবস্তু নিজেই। এই অর্থ, মুনাফা, পুঁজি ইত্যাদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে কী রকমভাবে প্রভাবিত করে রাখে তার সম্বন্ধে আমাদের কিছু ধারণা তো আছেই। দাস কাপিতাল তার সুপ্রশস্ত এবং সুবিন্যস্ত পরিসরে যে ভাবে এই বিষয়গুলোকে ধরে ধরে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের সামনে হাজির করে, গড়পড়তা অর্থনীতির চালু কথাবার্তার থেকে তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা এতটাই বেশি, যে এই আমাদের ধারণাগুলো ক্রমে আরও স্বচ্ছ হয়ে আসে।

দাস কাপিতালের শুরুটা খানিকটা গোয়েন্দা গল্পের মত। যে সব ছোট ছোট ঘটনা আমাদের সামনে ও চারদিকে ঘটছে (বা ‘ক্লু’ রেখে যাচ্ছে), সেগুলোকে জুড়ে জুড়ে একটা বড় ছবি – যার কথা আমরা হয়ত ভেবেও দেখিনি – দাস কাপিতাল তৈরি করে ফেলে। ইন্সপেক্টর মার্ক্স যখন সিনে এলেন, খুনটা হয়েছে কি হয়নি তখনও আমরা জানি না। কিন্তু খুনটা যে হয়েছেই, কালক্রমে সেইটা আমরা ধরে ফেলতে পারি।